▌আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে গাছের একটা পাতাও নড়ে না
কথাটি আমাদের সমাজে বেশ প্রচলিত। অন্যান্য প্রচলিত কথার মত এই কথাটি ভুল নয়, বরং, সত্য। আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে আসলেই কিছু হয় না।
তাহলে কি পাপ কাজ আল্লাহর ইচ্ছায় হয়? ভালো মন্দ সবই আল্লাহর ইচ্ছায় হয়?
উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছায় হয়।
আল্লাহ তা'আলা বলেন -
وَ مَا تَشَآءُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ اللّٰہُ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ
আর তোমরা ইচ্ছা করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ ইচ্ছা করেন। [সূরা তাকওয়ীর, আয়াত ২৯]
তাহলে পাপের কারণে কেন শাস্তি পেতে হবে?
এর উত্তরে আগে আল্লাহর ইচ্ছার প্রকার সম্পর্কে জানতে হবে।
আহলুস সুন্নাহ'র আকীদা হলো আল্লাহর ইচ্ছা দুই প্রকারঃ
১. ইরাদা কওনিয়্যা বা সৃষ্টিগত ইচ্ছা
২. ইরাদা শার'ঈয়্যা বা পছন্দগত ইচ্ছা
ইরাদা কওনিয়্যা বলতে আল্লাহর সৃষ্টিগত এবং সৃষ্টিজগতের সকল কিছুর বিষয়ে ইচ্ছা করাকে বুঝায়। সৃষ্টিগত ভাবে আল্লাহ তা'আলা ভালো মন্দ, পাপ পূণ্য, সবই সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর, বান্দার জন্য পূণ্য, ভালো ও ঈমানের আদেশ করেছেন এবং মন্দ, পাপ ও কুফর থেকে নিষেধ করেছেন।
একইভাবে, বান্দা যেসব কাজ করে থাকে সেসবও আল্লাহর সৃষ্টি। অস্তিত্বশীল সব কিছুকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
১. স্রষ্টা
২. সৃষ্টি
স্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পূর্ণ আলাদা। স্রষ্টার সত্তার সাথে জড়িত সবকিছু অসৃষ্ট, অনাদি ও অনন্ত।
স্রষ্টা ব্যতীত সবই সৃষ্টি। কাজেই মানুষ সৃষ্টি এবং মানুষের কর্মও আল্লাহর সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত।
কাজেই, আমরা বলতে পারি সৃষ্টিজগতে অস্তিত্বশীল সকল ভালো মন্দ, পাপ পূণ্য আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ এসব বিপরীতধর্মী বিষয় সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেছেন। ইচ্ছা করেই এসব সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ভালোকে পছন্দ করে, তার প্রতি আদেশ করেছেন এবং মন্দকে ঘৃণা করে তার থেকে নিষেধ করেছেন।
ইরাদা শারঈয়্যা বলতে আল্লাহর পছন্দনীয় ইচ্ছাকে বুঝায়। অর্থাৎ, ইরাদা শারঈয়্যা আল্লাহর পছন্দের সমার্থক। বান্দা যদি ভালো কাজ করে এবং সৃষ্টিকুলের মধ্যে আল্লাহর প্রিয় যা আছে সব কিছুর পিছনে ইরাদা শারঈয়্যা কাজ করে।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। একজন শিক্ষক বহুনির্বাচনি প্রশ্ন প্রণয়নের সময় ৪ টি অপশন রাখেন। ৩ টি ভুল এবং ১ টি ঠিক। তিনি ইচ্ছা করেই ৩ টি ভুল অপশন রাখেন। কিন্তু, তার মানে কি তিনি চান ছাত্র ভুল করুক? না! তিনি চান না। তিনি কেবল পরীক্ষার জন্যই ভুল অপশন রাখেন।
ভুল যদি না থাকে ঠিকের মূল্য থাকে না। একইভাবে, অন্ধকার না থাকলে আলো মূল্যহীন। মন্দ না থাকলে ভালো মূল্যহীন।
কাজেই, আল্লাহর ঐশী প্রজ্ঞার দাবি হচ্ছে তিনি ভালো মন্দ উভয় সৃষ্টি করার ইচ্ছা করবেন। অতঃপর, ভালোর প্রতি নির্দেশ দিবেন ও খারাপ থেকে নিষেধ করবেন। আল্লাহ যদি কুফর এবং শিরক সৃষ্টি না করতেন তাহলে ঈমানের কী যথার্থতা থাকতো? যদি পাপ সৃষ্টি না করতেন তাহলে পূণ্যের কী যথার্থতা থাকতো?
পাপ, শিরক, কুফরকে বহুনির্বাচনির ৩ টি ভুল উত্তর আর ইসলাম ও পূণ্যকে ১ টি ঠিক উত্তরের সাথে তুলনা করলে সব সংশয় দূর হয়ে যায়। সৃষ্টি করার ইচ্ছা করা আর পছন্দ করা এক জিনিস নয়। কাজেই, নিজে পাপ করে সেটার দায় আল্লাহর উপর চাপানো যাবে না। কারণ, কর্মের ক্ষেত্রে আল্লাহ মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাকে ভালোর আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহর সৃষ্টি আর পছন্দ এক নয়। কাজেই, বান্দার দায়িত্ব আল্লাহর পছন্দের উপর আমল করা।
একটা জিনিস উল্লেখ্য, আল্লাহ মন্দ সৃষ্টি করেন। তার কিছু সৃষ্টি মন্দ। তবে সেসব মন্দ আপেক্ষিক। আল্লাহ পরম অর্থে কোনো মন্দ সৃষ্টি করেন না। সেসব মন্দ সৃষ্টির পিছনে আল্লাহর মহৎ উদ্দেশ্য ও প্রজ্ঞা থাকে। আল্লাহ মন্দ সৃষ্টি করলেও আল্লাহর প্রতি মন্দকে সম্বন্ধ করা যাবে না। আল্লাহর সৃষ্টি মন্দ হতে পারে, কিন্তু আল্লাহর উদ্দেশ্য, সৃষ্টি করার গুণ বা সিফাত মন্দ নয়৷ আল্লাহ তা'আলা সকল মন্দ বিশেষণে বিশেষায়িত হওয়ার ঊর্ধ্বে।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহিমাহুল্লাহ) বলেন -
পরম খারাপ বলে কিছু সৃষ্টি করেন না আল্লাহ। কল্যাণের নিরিখে তাঁর সৃষ্ট সবকিছুতেই থাকে এক প্রজ্ঞাময় উদ্দেশ্য। তবে, হতে পারে কিছু লোকের জন্য সেখানে কিছু অকল্যাণ আছে। এটা আংশিক, আপেক্ষিক অকল্যাণ। সম্পূর্ণ বা পরম অকল্যাণের বেলায় আল্লাহ দায়মুক্ত।
[মাজমূ ফাতাওয়া, খন্ড ১৪, পৃষ্ঠা ২৬৬]
সুতরাং,
১. আল্লাহ মন্দ সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেছেন পরীক্ষার জন্য।
২. তিনি পরম কোনো মন্দ সৃষ্টি করেন নি
৩. তিনি কাউকে কিছু করতে বাধ্য করেন না
৪. তিনি ভালো পছন্দ করেন ও তার আদেশ দেন
৫. মন্দ থেকে নিষেধ করেন
তাই, কেউ মন্দ করলে তার শাস্তি তাকেই পেতে হবে।
আল্লাহর সৃষ্টিগত ইচ্ছা ও পছন্দগত ইচ্ছার পার্থক্য বুঝলে অনেক সংশয় ও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।


0 মন্তব্যসমূহ